জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো কল্পনার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা এগারোটা। “ইস, বড্ড দেরি হয়ে গেলো আজ ঘুম থেকে উঠতে”। ঘুম চোখে জানলার বাইরে তাকায় কল্পনা। হঠাৎ বেশ ভালো লাগলো। শীতকালের বৃষ্টি California-র এই শহরতলির আকণ্ঠ তেস্টা মেটাচ্ছে। বাড়ির উলটোদিকে পেট্রলপাম্পটা ঝাপসা হয়ে গেছে। দূরে পাহাড়ে সবুজ রং লেগেছে। বেশ একটা মায়াবী ব্যাপার। মনটা বেশ খুশীতে ভরে যায়।
প্রায় চার বছর হোল কল্পনা প্রবাসী। স্বামীর বিদেশী ঘর করবে বলে চাকরীর পাট চুকিয়ে এক্কেবারে আমেরিকা। প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগত বিদেশের চাকচিক্য, প্রত্যেক লং উইকেন্ডে বেড়ানো, স্বপ্নের জায়গাগুলো বাস্তবে দেখা। অথচ আস্তে আস্তে সেই নতুন ভালো লাগা গুলো কবে উবে গেলো টেরও পায়নি ও। এখন বড্ড লক্ষ্যহীন লাগে জীবনটা। বেশীরভাগ সময়ে অস্থির লাগে। কিন্তু আজ সেইসব বাস্তবতা ছুঁতে পারছেনা কল্পনাকে।
হঠাৎ স্বপ্নিলের কথা মনে পড়ে যায়। স্বপ্নিল বৃষ্টি ভালবাসত খুব। পুজোর সময়ও বৃষ্টি হলে আনন্দ পেতো। বারবার ঠাণ্ডা লাগলেও সুযোগ পেলেই বৃষ্টিতে ভিজবেই। হাল্কা একটা হাসির রেখা ফোটে কল্পনার ঠোঁটে। সেই প্রথম চুমু খাওয়ার দিনটা যেমন… হেমন্তের আঝোরে বৃষ্টি সেদিন কলকাতায়, আর কল্পনার বুকের ভেতরে, শরীর জুড়েও। সত্যি, কিছু মুহূর্ত যেন থেমে থেকে যায়। পাশবালিশটা কাছে টেনে নেয় কল্পনা। চেপে ধরে শুয়ে থাকে।
কলকাতায় তখন প্রায় মাঝরাত। স্বপ্নিলের কাজের সময়। আসলে ঘুম, আর কিছু দৈনন্দিন কাজ ছাড়া, বাকি পুরো সময়টাই তো কাজের সময় স্বপ্নিলের। এ যেন এক স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিজের কাছ থেকে। একটা নেশা, যা মনের গোপন অনুভূতিগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে দিনের পর দিন।
হাল্কা শীত পড়তে না পড়তেই শহরে আবার পশ্চিমি ঝঞ্ঝার আগমন। অতয়েব মেঘলা আবহাওয়া। ঝিরঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। শহরবাসী বিরক্ত। স্বপ্নিল বেশ খুশী। যেকোনো বৃষ্টিই ওর কাছে প্রিয়। ভিজতে ইচ্ছে করে। আজকাল পারেনা। দায়িত্বশীল গৃহকর্তার ভূমিকার সাথে ঠিক খাপ খায় না।
আজ ল্যাপটপের থেকে চোখ সরে যাচ্ছে বারবার স্বপ্নিলের। জানালার দিকে তাকালো। সাততলার ওপর থেকে বেশ সুন্দর লাগছে শহরটা। রাস্তার শব্দ খুব একটা নেই। একটা দুটো গাড়ি যাচ্ছে। এইজন্যই তো বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে আশা।
হঠাৎ কল্পনার কথা মনে পড়ে। ওর বৃষ্টি-প্রেম নিয়ে খুব খ্যাপাত কল্পনা। ওর বউয়ের নাম হবে নাকি বর্ষা। facebook খুলে কল্পনার profile দেখে স্বপ্নিল। শেষ ছয়মাসে একই ছবি। কল্পনা ঘন ঘন ছবি পালটায় না। পাছে লোকজন বেশী কমেন্ট করে। জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ওর পছন্দ না। বরাবরই একটু আড়ালে থাকতে ভালবাসত। বেশীরভাগ লোকজনের সাথেই মিশতে পারত না কল্পনা। কথা বলার কিছু খুঁজে পেত না। অথচ স্বপ্নিলের সাথে কথা শুরু হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। সারারাত ফোনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দুজনে আবিষ্কার করত ভোর হয়ে গেছে। সেইরকম একদিন, রাতে কথা বলতে বলতে ওরা একসাথে গান শুনছিল দুজনে চুপ করে। এটা স্বপ্নিলের আইডিয়া। কল্পনা বাংলা গান খুব বেশী শোনেনি। তাই স্বপ্নিলের মনে হত ভালো বাংলা গান শোনানো ওরই দায়িত্ব। সেদিন শুনছিল “আদরের নৌকো”। একবার নয়। পরপর চারবার। কারোর কোন তাড়া ছিল না। পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না। হঠাৎ বৃষ্টির শব্দে ওরা চমকে ওঠে দুজনেই সেদিন। সেইরকম একটা মনে হচ্ছে যেন আজ। কল্পনার আমেরিকার নম্বর স্বপ্নিলের মুখস্ত। কিন্তু সাহস করে ফোন করা হয়নি কোনদিন। হঠাৎ কি হোল আজ। ফোনে Dial করেই ফেলল নম্বর টা।
কল্পনা তখনো বিছানায়। গত কয়েকদিনের তিক্ততা ভুলে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। তাই এই ভালোলাগাটাকে বেশ জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। পাশবালিশটাই যেন ওর সবচেয়ে প্রিয় এই মুহূর্তে। আর তার সাথে কিছু পুরনো কথা, বৃষ্টিভেজা, স্বপ্নময়। এই সময়টা যেন শিগগিরই ফুরিয়ে না যায়। হঠাৎ ফোনে রিং। কলকাতার নম্বর। চেনা নম্বর নয়। এত রাতে আবার কলকাতা থেকে কে ফোন করল? হঠাৎ মনে হোল, স্বপ্নিল নয়ত? ধুস, পাগলের ভাবনা যত রাজ্যের, স্বপ্নিল আবার কেন ফোন করবে? সে তো সুখে সংসার করছে কলকাতায়। কিন্তু বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা অনুভব করছে কল্পনা। কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। ধরবে? হঠাৎ ফোনটা কেটে গেলো। উফ, হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল কল্পনা। redial করবে? নাহ। নিশ্চয় কেউ ভুল করেই করেছে। যতসব আজব ভাবনা। কল্পনা বিছানা থেকে নামল, সেইসাথে বাস্তবতাটাও ফিরে এলো। আবার আরেকটা ঘটনাবিহীন দিন কাটাতে হবে। ভীষণ খারাপ লাগছে আবার…
কলকাতায় তখন স্বপ্নিল ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল। ধরল না কল্পনা। ইচ্ছে করেই? নাকি দেখতে পায়নি? পরে ring back করবে? আবার করবে? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আচমকা যান্ত্রিক শব্দে ঘোর কেটে গেলো। Skype-e কল এসেছে head office থেকে। New York City Calling…
একুশে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ © প্রত্যয় মুখার্জী